তিন ভূবনের দাপুটে তিন তারকার গল্প

তিন ভূবনের দাপুটে তিন তারকার গল্প

বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের তিন শীর্ষ তারকা আসিফ আকবর, শাকিব খান ও জিয়াউল ফারুক অপূর্ব। দীর্ঘদিন আগে আসিফ গানের ভুবনে, শাকিব চলচ্চিত্র অঙ্গনে এবং অপূর্ব নাট্যাঙ্গনে যাত্রা শুরু করলেও এখনো তিনজনই সমানতালে সমান জনপ্রিয়তা নিয়ে নিজ নিজ অঙ্গনে কাজ করে যাচ্ছেন।

 

বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনে নতুন এক ধারার সৃষ্টি করেছিলেন যুবরাজখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী আসিফ। ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’ এই একটি মাত্র গান দিয়েই তিনি তার ক্যারিয়ারের শুরুতে সারা বাংলাদেশের গানপ্রেমী শ্রোতাদের মনে আলোড়ন তুলেছিলেন। যে সময়ে এই গানটি প্রকাশিত হয় সেই সময়ই গানটি ক্যাসেটের জগতে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া ক্যাসেট হিসেবে বিবেচিত হয়।

 

শুধু তাই নয়, এ যাবতকাল আসিফের প্রথম অ্যালবামটিই এখন পর্যন্ত ক্যাসেটের বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া ক্যাসেট। মাঝে রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত থাকার কারণে আসিফ গানে বিরতি নিয়েছিলেন। প্রায় তিনবছর বিরতিতে থাকার কারণে গানে আসিফকে পাওয়া যায়নি। কিন্তু গানের মানুষ কি আর গানের ভূবন থেকে দূরে থাকতে পারেন! পারেননি বলেই আবার তিনি গানে ফিরে আসেন। সেই একই উদ্যম নিয়ে আবার আসিফ গান শুরু করেন।

 

এবার যেন কন্ঠ আরো ধারালো হয়, তার ভক্ত শ্রোতারা নতুন এক আসিফকে খুঁজে পান। সময়ের সাথে সাথে আসিফ নিজেকেও বদলে নেন। সময়ের চাহিদাকে বিবেচনা করে গান শুরু করেন তিনি। শুধু গানেই নয়; মিউজিক ভিডিওগুলোতে আসিফের নায়কোচিত উপস্থিতিও তার ভক্ত দর্শকের মধ্যে অন্যরকম ভালোলাগার সৃষ্টি করে। আসিফ প্রমাণ করেন তিনি অন্যরকম, আলাদা। তাই দিনে দিনে যেন আসিফ ভক্তর সংখ্যা যেন বেড়েই চলেছে।

 

ছোটবেলায় ক্রিকেট খেলার প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ ছিলো তার। এখনো সুযোগ পেলে ক্রিকেটের ব্যাট হাতে নিয়ে মাঠে নামেন আসি। তবে সবসময়ের মতো গানটাই তাকে বেশি টানে। কুমিল্লা জিলা স্কুল, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আসিফ তার পড়াশুনা শেষ করেন। আসিফ বিশ্বাস করেন নতুন প্রজন্ম যদি হাল না ধরে রাখতো তাহলে সঙ্গীতাঙ্গনে হয়তো দূরাবস্থা নেমে আসতো।

 

আসিফ বলেন, মাঝে একটা সময় গেছে যখন আমাদের চলমান সঙ্গীতাঙ্গনের হাল ধরে রেখেছিলো ইমরান, বেলাল খান, অয়ন চাকলাদার, আরিফিন রুমি। তারা গানও গেয়েছে আবার সুর সঙ্গীতও করেছে। যে কারণে আমাদের সঙ্গীতাঙ্গনে অনেক ভালো গান হয়েছে। কিছু নতুন নতুন শিল্পীরও জন্ম হয়েছে। আমি এই হাল ধরে রাখা শিল্পীদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। আর একটি কথা না বললেই নয়, ইমরান নতুন প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পী। ইমরান আমাদের দেশের গর্ব। সে নিজে যেমন ভালো গান গাইছে। আবার অন্যদের জন্য ভালো গান সৃষ্টি করছে। ইমরানকে অবশ্যই আমাদের সাধুবাদ জানানো উচিত। ইমরানের মতো আরো অনেকেই যারা আমাদের সঙ্গীতাঙ্গনকে সমৃদ্ধ করছেন অবশ্যই তাদের সাধুবাদ জানানো উচিত বলে আমি মনেকরি। কারণ এই নতুন প্রজন্মের হাত ধরেই আমাদের সঙ্গীতাঙ্গন আগামীর পথে এগিয়ে যাবে।

 

চিত্রনায়ক শাকিব খানের অভিনয় ক্যারিয়ার আজ থেকে ১৯ বছরেরও বেশি সময় আগে শুরু হলেও তার অভিনয়ে দর্শক বেশি মুগ্ধ হন প্রথম হাছিবুল ইসলাম মিজান পরিচালিত ‘আমার স্বপ্ন তুমি’ চলচ্চিত্রে। এই চলচ্চিত্রে শাকিব খানের সহশিল্পী ছিলেন শাবনূর, ফেরদৌস ও এটিএম শামসুজ্জামান।

 

‘আমার স্বপ্ন তুমি’ চলচ্চিত্রে শাকিবের অনবদ্য অভিনয় নির্মাতাদের চোখে শাকিবকে নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেন। এরপর শাকিব অভিনীত এফ আই মানিক পরিচালিত ‘কোটি টাকার কাবিন’, ‘চাচ্চু’, ‘দাদী মা’ও ব্যবসা সফল হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে বদিউল আলম খোকন পরিচালিত ‘ প্রিয়া আমার প্রিয়া’ চলচ্চিত্রে শাকিব সাহারা জুটির অনবদ্য অভিনয়, গান দর্শককে মুগ্ধ করে।

 

ব্যবসা সফল এই চলচ্চিত্রের পর শাকিবকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বলা যায় গত প্রায় দশ বছর ধরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে শাকিব খান এক অঘোষিত রাজত্বই করছেন। অভিনয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও।

 

শাকিব খানের নায়িকা হিসেবে ইরিন জামান, মুনমুন, শাবনূর, পপি, পূর্ণিমা, অপু বিশ্বাস, সাহারা, রেসি, বিদ্যা সিনহা মিম, ববি, শখ, বুবলীসহ আরো অনেকেই অভিনয় করেছেন। আর এই সময়ে শাকিব চলচ্চিত্রের এমন একটি অবস্থানে আছেন যেখানে তারসঙ্গে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করার জন্য নায়িকারা অপেক্ষায় থাকেন।

 

শুধু বাংলাদেশের নায়িকাদের বিপরীতে চলচ্চিত্রেই অভিনয় করেছেন এমনটি নয়, কলকাতার নায়িকারাও তার বিপরীতে অভিনয় করে তার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছেন। যেমন শ্রাবন্তী, শুভ্রশ্রী, নূসরাত। ঝিনুক কথাচিত্র প্রযোজিত পরিবেশিত আফতাব খান টুলু পরিচালিত ‘সবাইতো সুখী হতে চায়’ চলচ্চিত্রে প্রথম শাকিব খান চুক্তিবদ্ধ হন নৃত্য পরিচালক আজিজ রেজার সহযোগিতায়। কারণ তার কাছেই শাকিব খান পড়াশুনার পাশাপাশি নাচ শিখতেন। এতে তার বিপরীতে ছিলেন নবাগত কারিশমা শেখ। কিন্তু দর্শক শাকিব খানকে প্রথম দেখেন এস.পি প্রোডাকশন প্রযোজিত পরিবেশিত সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত ‘অনন্ত ভালোবাসা’ চলচ্চিত্রে। এই চলচ্চিত্রে তার বিপরীতে ছিলেন চিত্রনায়িকা মৌসুমীর ছোট বোন ইরিন জামান। প্রথম চলচ্চিত্রে শাকিব খানকে দেখে তার মধ্যে নতুন এক সম্ভাবনা খুঁজে পায় চলচ্চিত্রাঙ্গন। তারপর থেকে আজকের শাকিব খান হয়ে উঠা যুদ্ধে জয়ী হয়ে উঠার গল্প।

 

শাকিব খান বলেন, সবার সহযোগিতায় এখনো বেশ ভালোভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আল্লাহর কাছে অনেক শুকরিয়া। আমি আমার পরিকল্পনা মতোই কাজ করে যাচ্ছি। দেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। সবার সহযোগিতা থাকলে আরো দীর্ঘ সময় নিজে ভালো কিছু চলচ্চিত্রে কাজ করে যেতে চাই।

 

আমাদের দেশে নাট্যাঙ্গনের এই সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতাদের মধ্যে অন্যতম হলেন জিয়াউল ফারুক অপূূর্ব। অনেকেই অপূর্বকে এক্সপ্রেসন মাস্টার হিসেবেও আখ্যা দিয়ে থাকেন। অভিনয়ের পথে চলতে চলতে অপূর্ব নিজেকে এমন অবস্থানে নিয়ে গেছেন যেখানে থেকে তিনি চাইলেই কোনরকম স্ক্রিপ্টে কাজ করতে পারেন না। তাই তাকে নাটকে বা টেলিফিল্মে নেবার আগে একজন পরিচালককে ভালো স্ক্রিপ্টের ব্যাপারে শতভাগ চিন্তা করতে হয়।

 

অভিনয়ের পথচলা শুরু হবারও আগে ২০০৪ সালে অপূর্ব প্রথম অমিতাভ রেজার নির্দেশনায় নেসক্যাফের বিজ্ঞাপনে মডেল হিসেবে কাজ করেন। তারপর মাঝে দুই বছর র‌্যাম্প, বিজ্ঞাপনের ফটোশ্যুট’সহ আরো নানান কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। ২০০৬ সালে তিনি প্রথম অভিনয় করেন গাজী রাকায়েত’র নির্দেশনায় ‘বিয়ের গল্প’ নাটকে। এতে তার বিপরীতে ছিলেন তানভীন সুইটি।

 

প্রথম নাটকেই অপূর্বর অভিনয় দর্শকের মন কেড়ে নেয়। আর এর পরের গল্পটা শুধুই সামনে এগিয়ে যাবার গল্প। বিশেষত ‘ল্যাবএইড’র বিজ্ঞাপনে মডেল হিসেবে কাজ করার পর অপূর্বর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। জানা যায় এই সময়ে প্রায় সব রোমান্টিক গল্পের স্ক্রিপ্ট যেমন সবার আগে অপূর্বর কাছে পৌঁছায় ঠিক তেমনি একটু অফট্র্যাকধর্মী গল্পের স্ক্রিপ্টও তার কাছে পৌঁছায়। যদি গল্প ভালোলেগে যায় তার তবেই সে নাটকে অভিনয় করেন অপূর্ব।

 

অপূর্ব অভিনীত প্রথম ধারাবাহিক নাটক শিহাব শাহীন পরিচালিত ‘রমিজের আয়না’। এই নাটকে অভিনয় করেও বেশ আলোচনায় আসেন ক্যারিয়ারের শুরুতেই। অপূর্ব এখন পর্যন্ত বহু দর্শকপ্রিয় নাটক উপহার দিয়েছেন। নিজেও নির্মাণ করেছেন ‘ব্যাকডেটেড’ নামের একটি টেলিফিল্ম। ব্যয়বহুল এই টেলিফিল্মটি নির্মাণ করেও নির্মাতা হিসেবে দারুণ প্রশংসিত হয়েছেন অপূর্ব।

 

টিভি নাটকে রোমান্টিক জুটি হিসেবে আফজাল সুবর্ণার পরে আর কেউ জুটি হিসেবে তেমন জনপ্রিয়তা না পেলেও অপূর্ব তার অভিনয়ের মধ্যদিয়ে যে রোমান্টিক ইমেজ তৈরী করেছেন তা তার সময়কালে আর কেউ পারেনি। গত বছর তার অভিনীত মিজানুর রহমান আরিয়ান পরিচালিত ‘বড় ছেলে’ এবং গেলো ভালোবাসা দিবসে শিহাব শাহীন পরিচালিত ‘তুমি যদি বল’ নাটকে অপূর্ব’র অনবদ্য অভিনয় দর্শককে মুগ্ধ করেছে। দুটি নাটকেই তার বিপরীতে ছিলেন মেহজাবিন চৌধুরী।

 

দিন যতো যাচ্ছে অভিনয়ে অপূর্ব নিজেকে অনেক বেশি পরিপক্ক করে তুলছেন। একজন জাত অভিনেতা হিসেবেও নির্মাতাদের কাছে তার কদর রয়েছে অনেক। নির্দিষ্ট কোনো গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে নয়, বহুমাত্রিক চরিত্রে অভিনয় করতেই তার স্বাচ্ছন্দ্যতা।

 

অপূর্ব বলেন, একজন অভিনেতা হিসেবে পরিপূর্ণ হবার স্বপ্ন দেখি সবসময়। প্রতিটি নাটকের প্রতিটি চরিত্র নিয়ে আমি ভীষণ ভাবি। যতোটা ভালোভাবে চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তোলা যায় তা নিয়ে পরিচালকের সঙ্গে আলোচনাও করি। আমি চাই আমার প্রতিটি কাজই দর্শক দেখুক, বিচার করুক কেমন হয়। কারণ অভিনয়ই আমার পেশা। তাই অভিনয়ে সর্বোচ্চ ভালোটাই করতে চাই আমি। আমাদের নাট্যাঙ্গনে নতুনদের জোয়ার বইছে। নতুনরাও অনেক ভালো করছে। তাদের জন্য সবসময়ই আমার শুভকামনা। কোন নতুন শিল্পী আমার সঙ্গে একই ফ্রেমে কাজ করলে আমি তাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করার চেষ্টা করি। কারণ একটি কাজে সবাই একে অন্যের পরিপূরক।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment